বিজয়ের মাস ডিসেম্বর : ইসলামের দৃষ্টিকোণ
১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম
শুরু হয়েছে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর ২০২৪। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে এই মাসের ১৬ তারিখে চূড়ান্ত বিজয়ের মাধ্যমে বাঙালি জাতির জীবনে সবচেয়ে গৌরবের অধ্যায় রচিত হয়। এ ডিসেম্বরের বেশ কিছু ঘটনা মুক্তিযুদ্ধে বিজয়কে দ্রুত ত্বরান্বিত করে। বাঙালি জাতি গৌরবের এই বিজয়ের ৫১ বছর ইতোমধ্যে পার করছে। আজকের নিবন্ধে ইসলামের দৃষ্টিতে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর নিয়ে আলোকপাত করা হল। স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার, যা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য এক বিশেষ নেয়ামত। এ অধিকার যে কত বড় মাপের, তা পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধরাই কেবল অনুধাবন করতে পারেন। মহান আল্লাহ তা খর্ব করার অধিকার দেননি কাউকে। ইসলামের শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠিত এ অধিকার খর্ব করা যেমন মানবাধিকার পরিপন্থী; তেমনি মহান আল্লাহর আইনের বিরোধীও বটে। শান্তির ধর্ম ইসলাম গতানুগতিক কোনো স্বাধীনতার স্লোগান নিয়ে আসেনি, বরং বিশ্ব মানবতার সামগ্রিক জীবনে মুক্তি, সাম্য ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার বাস্তব কর্মসূচি দিয়ে মানুষকে সৎপথে চলার দিক-নির্দেশনা দিতে এসেছে।
মানুষের বহুরূপ দাসত্ব-শৃঙ্খলের বিরুদ্ধে ইসলাম স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। বিশ্বাসের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা এবং সমালোচনা সবক্ষেত্রেই ইসলাম এই স্বাধীনতা দিয়েছে। ইসলাম মানুষকে চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির স্বাধীনতা দিয়ে মানব অস্তিত্বে স্বাধীনতার বীজবপন করে দিয়েছে। ইসলাম মানুষকে সঠিক পথ প্রাপ্তির জন্য কোরআন নিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণ ও চিন্তাভাবনা করার আহ্বান জানিয়েছে। আর আমরা মুসলিম, একটি বিজয়ী জাতির রাজ্য-হারানো, পথহারানো এবং স্মৃতি-হারানো সৈনিক দল।
আমরা অনেকেই ভুলে গেছি, আমাদের আছে এক সমৃদ্ধ ইতিহাস, যে ইতিহাসের প্রদীপ্ত অংশ নবী-যুগ ও খিলাফতে রাশিদা। আমাদের আছে এক সুমহান আদর্শ, যে আদশের মহান সূত্র আল্লাহর শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং যে আদর্শের বাহক উম্মাহর সর্বোত্তম অংশ সাহাবায়ে কেরাম। আমরা ভুলে গেছি মানবেতিহাসের ওই প্রোজ্জ্বল অধ্যায়, যখন ‘সত্য’ ও ‘শক্তির’ ঘটেছিল শুভ পরিণয়। শক্তি ছিল সত্যের বধু। আর সত্য ছিল শক্তির অভিভাবক। এই পবিত্র ‘পরিবারে’ অবির্ভাব ঘটেছিল এমন এক মহান-কাফেলার, যারা ছিলেন এই আসমানী সনদের সত্য দৃষ্টান্ত-‘যাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করলে তারা সালাত কায়েম করবে, যাকাত দিবে এবং সৎকাজে আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে। আর সকল কর্মের পরিণাম তো আল্লাহরই ইখতিয়ারে।’-সূরা হজ্ব (২২) : ৪১
আমরা ভুলে গেছি আমাদের স্বর্ণ-যুগের সততা ও ন্যায়পরায়ণতা এবং উদারতা ও মহানুভবতা। মনে পড়ে কি, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ-হিজরতের রাতে রক্ত-পিপাসু শত্রুজাতির আদর্শ আমানত রক্ষা বিজয়ের দিনে পরাজিত শত্রুকে ক্ষমা করা? আমরা হারিয়ে ফেলেছি আদর্শের বিষয়ে আমাদের সেই পবিত্র-সংবেদন, আর আদর্শ-রক্ষায় সেই প্রাণবাজি রাখার প্রেরণা। মনে পড়ে কি, আল্লাহর রাসূলের প্রথম খলীফার সেই বজ্রহুঙ্কার-‘আ-য়ানকুসুদ দীন ওয়া আনা হাই?’ দ্বীনের অঙ্গহানী ঘটবে আর আমি বেঁচে থাকব?! আমরা ভুলে গেছি হযরত ওমরের ‘প্রজাপালন’, হযরত উসমানের এক গিলাফে ‘কুরআন-সংকলন’, এবং হযরত আলীর জ্ঞানের দুয়ার উন্মোচন। ভুলে গেছি হযরত হাসান রা.-এর সন্ধি আর হযরত হোসাইন রা.-এর অস্ত্রধারণ। বন্ধু! মুসলিম-উম্মাহর সেই যুগ ছিল মানবতারও স্বর্ণযুগ। ঐ সময়ে মুসলিমজাহান মুক্ত ছিল ধর্মহীন রাজ্যের অনাচার আর রাজ্যহীন ধর্মের অসহায়ত্ব থেকে।
এরপর ধীরে ধীরে শুরু হল পশ্চাদপসরণ। শুরু হল সৌভাগ্য থেকে দুর্ভাগ্যের দিকে যাত্রা। ক্রমেই শিথিল হয়ে এল জীবন ও আদর্শের বন্ধন, বিচ্ছিন্ন হতে লাগল জীবনের ক্ষেত্রগুলো একে অপরের থেকে, ব্যক্তিজীবন ও সমাজজীবনে দেখা দিল বিরোধ এবং আদর্শের পতাকাবাহী শ্রেণী থেকে পিছিয়ে পড়ল শক্তির অধিকারী শ্রেণী। এভাবে খাইরূল কুরূনের পর থেকে ধীরে ধীরে এক উম্মাহর মাঝে দুটি ধারা সুস্পষ্ট হয়ে উঠল। ‘সত্যে’র ধারা এবং ‘শক্তি’র ধারা। প্রথম ধারাটি ত্যাগ ও সাধনা এবং সাহসিকতা ও মহানুভবতায় ভাস্বর। আর দ্বিতীয় ধারাটিতে শৌর্য-বীর্যের পাশাপাশি আরম্ভ হল অন্তর্দন্দ্ব ও ক্ষমতার প্রতিযোগিতাও। কিন্তু ভোগ ও দ্বন্দ্বের ঘুণ এই প্রতিষ্ঠানটিকে সম্পূর্ণ অকেজো করার আগ পর্যন্ত এতেও ছিল ঐসকল আলোকিত বৈশিষ্ট এবং মানবীয় উচ্চতার ঐসব দৃষ্টান্ত, যা বর্তমান সভ্য-যুগেও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
এরপর এল সেই অন্ধকার যুগ, যখন মুসলিম-জাহান খন্ড-বিখন্ড হয়ে গেল। আর মুসলিম জনপদগুলোতে বইতে লাগল অশ্রু ও রক্তের স্রোত। দেশে দেশে প্রবর্তিত হল আদর্শবিমুখ শিক্ষা ও ভোগ-সর্বস্ব সংস্কৃতি। এরই বিষাক্ত আবহে তৈরি হতে থাকল এমন এক প্রজন্ম, যারা নিজেদের আদর্শের বিষয়ে অজ্ঞ, ঐতিহ্যের বিষয়ে নির্লিপ্ত এবং ধর্ম-পরিচয়ের বিষয়ে চরমভাবে হীনম্মন্যতাগ্রস্ত। কালের চাকা কখনো থেমে থাকে না। একসময় এরাই উঠে এল উপরে, চালকের আসনে। এদের হাতে ন্যস্ত হল ‘শক্তি’, ন্যস্ত হল ‘শিক্ষা’ এবং ন্যস্ত হল সমাজ-পরিচালনার গুরুদায়িত্ব। এদিকে উম্মাহর কফিনে যেন শেষ পেরেকটি ঠোকার হিংস্র ইচ্ছা থেকে তৈরি করা হল অনেক ধর্মীয় মতবাদ এবং কিছু ধর্মগুরু। সৃষ্টি করা হল মিথ্যা নবুওয়াতের দাবিদার। প্রাদুর্ভাব ঘটল ‘প্রাচ্যবিদ’ নামক একদল ‘গবেষকে’র, যারা ইসলামের ইতিহাসকে বিকৃত করতে এবং ইসলামী আদর্শের সূত্র-কুরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে ধর্ম-জ্ঞানহীন মানুষকে সংশয়গ্রস্ত করতে অসংখ্য কূটপ্রশ্নের অবতারণা করল। নবউদ্ভাবিত সমস্যাদির ইসলামী সমাধানের পরিবর্তে স্বতঃসিদ্ধ ও প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় বিষয়ে সংশয় সৃষ্টির প্রয়াস চলতে থাকল। বিভিন্ন নামে ও শিরোনামে উম্মাহর সাচ্চা খাদিমগণকে- সাহাবা-তাবেয়ীনকে, মুহাদ্দিস ও মুজতাহিদগণকে এবং মুজাহিদ ও দায়ীগণকে উম্মাহর শত্রু ও খলনায়ক রূপে উপস্থাপন করা হল।
একই সাথে ইসলাম-বিদ্বেষী পশ্চিমে চলতে থাকল নির্জলা মিথ্যাচার। এভাবে ইসলামের পবিত্র জীবনাদর্শ ও গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে তমসাচ্ছন্ন করার এবং উম্মাহকে তার অতীত সম্পর্কে বিমুখ, বর্তমান সম্পর্কে অস্থির এবং ভবিষ্যত সম্পর্কে হতাশ করে তোলার কোনো অপচেষ্টাই বাদ রাখা হল না। কিন্তু ইসলাম যে আবে হায়াত। এরই স্পর্শে বারবার জেগে উঠেছে মৃতপ্রায় মুসলিম। কুরআন-সুন্নাহ যে ঐশী আলোক, এরই অনির্বাণ শিখায় বারবার জ্বলে উঠেছে উম্মাহর নিভু নিভু প্রদীপ। মিথ্যুক-জুলুমবাজদের অত্যাচার-মিথ্যাচারে জেগে উঠেছে উম্মাহর প্রাণের স্পন্দন। নির্যাতনের শিল-পাটায় নিস্পেষিত মুসলিম হয়ে উঠেছে মেহেদী-রাঙ্গা। দিকে দিকে তাই বুঝি শোনা যায় সেই পুরানো দিনের ধ্বনি-‘অহুদ পাহাড়ের পাদদেশ থেকে আসছে বেহেশতের সুবাস।’ বিশ্বমানবতাও কি ব্যাকুল হয়ে উঠেছে সাম্য ও শান্তির অপেক্ষায়? প্রাণের স্পন্দন ও আকুতি কি ছড়িয়ে যাচ্ছে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে, এবং ব্যক্তি থেকে সমাজে?
নিশ্চয়ই এই স্পন্দিত প্রাণ আবার জাগবে নতুন শক্তি ও চেতনায়। এই মরা গাঙ্গে আবার আসবে জোয়ার। সেই জোয়ারে খরকুটোর মতো ভেসে যাবে সকল জঞ্জাল। আবার গড়ে উঠবে জীবন ও আদর্শের মাঝে মেলবন্ধন। যুক্ত হবে উম্মাহর সকল বিচ্ছিন্ন কলকব্জা। ‘সত্যে’র নির্দেশনায় ‘শক্তি’ ধাবিত হবে শান্তির পথে। সেই দিন মানবতার প্রকৃত বিজয় সাধিত হবে। পরিশেষে বলতে চাই, বিজয়ের এই মাসে মহান আল্লাহ তাআলা প্রশংসা ও দেশের জন্য আত্মদানকারী সব শহীদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা দেশের সব নাগরিকের ঈমানের অকাট্য দাবি। স্বাধীনতার জন্য জীবন দেয়া বীর শহীদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করা। তাদের পরিবার-পরিজনের খোঁজ-খবর নেয়া। তাদের প্রতি সমবেদনা জানানো। বিজয়ের এই মাসে সব শহীদের আত্মার মাগফেরাত কামনার পাশাপাশি দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় একাত্মতা প্রকাশ করে দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত থাকাই হোক প্রতিটি নাগরিকের দৃপ্ত শপথ।
বিভাগ : ইসলামী জীবন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
পরলোকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং :ভারতে ৭ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা
কালীগঞ্জে রাঙ্গামাটিয়া ধর্মপল্লীর সংবাদ সম্মেলন
গ্রাম আদালত সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরিতে সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত
মিসরে প্রেসিডেন্ট সিসির বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ
কুর্দি যোদ্ধাদের ভয়ঙ্কর হুঁশিয়ারি এরদোগানের
৩৫শ’ এজেন্টের অধিকাংশই গুজরাটের পাচারকারী
৫ সাংবাদিককে হত্যা করল ইসরাইল বিমান
তুষারপাতে অচল হিমাচল দুই শতাধিক রাস্তা বন্ধ
ক্রিপ্টো রিজার্ভ গড়বেন ট্রাম্প?
মোজাম্বিকে কারাদাঙ্গায় নিহত ৩৩, পলাতক ১৫০০ কয়েদি
গাজায় যুদ্ধবিরতি বিলম্বে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ হামাস-ইসরাইলের
পাকিস্তানে সড়ক অবরোধে শতাধিক শিশুর প্রাণহানি
আফগানিস্তানে ৭১ সন্ত্রাসীকে হত্যা করেছে পাকিস্তান
শুধু নারীদের জন্য
নিথর দেহ
আত্মহননে
জকিগঞ্জে প্রাক্সিসের ৭ দিনব্যাপী ইংলিশ স্পিকিং চ্যালেঞ্জ কম্পিটিশনের পুরস্কার বিতরণী
মাদ্রাসার ছাদ থেকে পাইপ বেয়ে নামার সময় পড়ে গিয়ে শিশুর মৃত্যু
গাজীপুরে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতাকে ছাড়িয়ে আনতে থানায় বিএনপি নেতাদের ভিড়
শুধু নামেই জিমনেসিয়াম